সদাশিব

বাংলার শিশু-কিশোর সাহিত্যে সদাশিব একটি অবিস্মরনীয় নাম| সদাশিব বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক সৃষ্টি|

১৬শ শতাব্দীর মহারাষ্ট্রে যখন শিবাজি, আদিল শাহ আর আওরঙ্গজেবের বিবাদ তুঙ্গে, সেই রকম এক জ্বালাময়ী পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রচিত শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের এই মহান ঐতিহাসিক উপন্যাস| এই কাহিনীর নায়ক সদাশিব একটি মারাঠি গ্রামের কিশোর - নানা ঘটনার কারণে সে একসময়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে|

সারসংক্ষেপ

১৬শ শতাব্দীর মহারাষ্ট্র - শিবাজি আর আওরঙ্গজেবের সেনাদলের মধ্যে সংঘর্ষ চরমে| মহারাষ্ট্রের উত্তরে দৌলাতাবাদে আছে মুঘলরা আর অন্যদিকে দক্ষিনে বিজাপুর দুর্গ অধিকার করে আছে আদিল শাহ| সাধারণ গ্রামবাসীরা এদের দ্বারা প্রায়শই অত্যাচারিত হয়| শিবাজীর সেনাদল এই অত্যাচারের অবসান ঘটাতে চায় কিন্তু তারা তখন জনসাধারনের বিশ্বস্ততা অর্জন করে উঠতে পারে নি|

এই রকম সময়ে একটি গ্রামে 'সদাশিব' - সতের আঠার বছর বয়সের এক অনাথ কিশোর, তার মামার আশ্রয়ে বড় হয়ে ওঠে| একদিন তার মামা, গ্রামের মোড়ল-মাতব্বরদের সাথে শলা-পরামর্শ করে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতলব করে| সদাশিবের গ্রামে তার শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে আছে এক 'কুমকুম', গ্রামের মোড়ল বিঠ্থল পাটিলের মেয়ে - সে তাকে পরামর্শ দেয় শিবাজীর সৈন্যদলে যোগ দেওয়ার জন্য| কুমকুম তাকে তার বাবার ঘোড়া চুরি করে সদাশিবকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে|

গ্রাম থেকে পালিয়ে সদাশিব পুনার দিকে রওয়ানা দেয়, পথে তার সাথে শিবাজীর সৈন্যদের দেখা হয়| সদাশিব না জেনেই তাদের সাহায্য করে আর পরে তারা তাকে তর্নায় নিয়ে আসে, যেখানে তখন শিবাজি শিবির করে আছেন| দিনে দিনে সে শিবাজি ও তার সেনাদের মধ্যে তার তারুন্য চাতুর্য্য ও বুদ্ধিমত্তার কারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে|

গল্প সার

সদাশিবের গল্প মোট পাঁচটি পর্বে বিভক্ত, সেগুলি এরকম ...

আদি কান্ড
২৬ শে মে, ১৯৫৭
সদাশিবের প্রথম গল্প, সদাশিব কেন ও কিভাবে বাড়ি থেকে পালালো তাই নিয়েই এই কাহিনী, সেদিক থেকে বিচার করলে এটিকে সদাশিব উপন্যাসের গৌরচন্দ্রিকাও বলা চলে|
অগ্নি কান্ড
২৮ শে জানুয়ারী, ১৯৫৮
৭০০০ বিজাপুরি সেনা নিয়ে সেনাপতি লিয়াকত খান তর্না আক্রমণ করে, শিবাজীর বন্দী হওয়া অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু তার মাঝে তিনি সদাশিবকে ছদ্মবেশে পালিয়ে যেতে বলেন যাতে সে বাইরে থেকে বাকি অভিযান সফল করতে পারে|
দৌড়াদৌড়ি কান্ড
১৮ ই ডিসেম্বর, ১৯৫৮
শিবাজীর বাবা শাহজী বিজাপুরের একজন ভূস্বামী| শিবাজি যখন বিজাপুরে একের পর এক দুর্গ আক্রমণ ও অধিকার করে চলেছেন, তখন বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ শাহাজির ওপরে বিরূপ হয়ে পড়েন| শিবাজি শঙ্কিত হন যে এই কারণে শাহাজির জীবন বিপন্ন হতে পারে - তিনি এই ব্যাপারে শাহজীকে সতর্ক করতে চান আর এই কাজের দায়িত্ব পরে সদাশিবের ওপরে, কারণ সদাশিবকে বিজাপুরের কেউই চেনে না| সদাশিব শিবাজীর প্রিয় ঘোড়া 'সিন্ধুঘোটক' এ সওয়ার হয়ে বিজাপুরে রওয়ানা দেয়|
হই হই কান্ড
২১ শে নভেম্বর, ১৯৬০
সদাশিব বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রায় এক বছর পর, একটা ছোট্ট কাজ সারতে তার গ্রামে ফিরে এলো| সে ভেবেছিল যে গ্রামের লোকেরা তাকে এখন অন্যভাবে নেবে, সে কুমকুমের জন্য শিবাজীর মা জিজাবাইয়ের দেওয়া একটা আংটিও নিয়ে এসেছিল, কিন্তু সে এসে দেখল যে পরিস্থিতি একটু অন্যরকম|
ঘোড়া ঘোড়া কান্ড
২২ শে মে, ১৯৬২
এক মহামারীর কারণে একসময়ে মহারাষ্ট্রে সুস্থ ঘোড়া পাওয়া দুস্কর হয়ে ওঠে| এই সময়ে কেবল মাত্র চন্দ্রগড় দুর্গেই ভালো ঘোড়া পাওয়া যেতে পারে যেখানকার অধিপতি ছিলেন শিবাজীর মামা বলবন্ত রাও| এক সময়ে শিবাজি তার মামা বলবন্তের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে তিনি কখনো চন্দ্রগড় আক্রমণ করবেন না| কিন্তু এই দুসময়ে বলবন্ত শিবাজীকে ন্যায্য দামে ঘোড়া বিক্রি করতে না চাইলে শিবাজি ঠিক করেন যে চতুরতার সাথে তাকে কিছু ঘোড়া যোগার করতে হবে, বলাই বাহুল্য এই কাজেও শিবাজীর ডান হাত হলো সদাশিব|

সদাশিবের গল্পের এই পাঁচটি খন্ড ছাড়াও সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের নোটবুক থেকে আরও চারটি খানদের খসড়া পাওয়া যায়, সেগুলি হলো,

রক্তারক্তি কান্ড, কেলেঙ্কারী কান্ড, বিদঘুটে কান্ড আর মহামারী কান্ড|

বোঝা যায় যে সদাশিবের কাহিনীর মধ্যে দিয়ে শরদিন্দু শিবাজীর উত্থানের পুরো ইতিহাস তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি তা শেষ করে উঠতে পারেন নি|

সদাশিবের গল্পের কিছু চরিত্র

সদাশিব সতের বছরের এক অনাথ কিশোর, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার এক গ্রামে তার মামা সখারামের কাছে বড় হয়ে ওঠে| একসময়ে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে শিবাজীর সৈন্য দলে যোগদান করে|
কুমকুমসদাশিবের ছোটবেলার বন্ধু এবং ওই গ্রামে সদাশিবের একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী| কুমকুম সদাশিবের গ্রামের মোড়ল বিথ্থল পাঠিলের একমাত্র মেয়ে| তার পরামর্শ মতই সদাশিব শিবাজীর সেনাদলে যোগ দেওয়ার জন্য গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়| ধরে নেওয়া যায় যে পরাবার্ত্তি কালে শিবাজির উদ্যোগে সদাশিব ও কুমকুমের বিয়ে হয়|
শিবাজি মহারাষ্ট্রের জাতীয় নায়ক, কিন্তু গল্পের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে একজন দস্যু বা লুটেরা বলে সবাই জানে|
জিজাবাই শিবাজীর মা ও শাহাজি ভোঁসলের স্ত্রী| মহারাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য শিবাজীর সমস্ত প্রচেষ্টার পিছনে একমাত্র অনুপ্রেরনা তিনিই|
তানজী শিবাজীর পরামর্শদাতা| ইনি শিবাজীর ছোটবেলার বন্ধুও বটে|
জেসাজি শিবাজীর আরেকজন পরামর্শদাতা ও ছোটবেলার বন্ধু
রত্নাজি বিজাপুরের পদাতিক সৈন্যের ছদ্মবেশে শিবাজীর গুপ্তচর, ইনিও শিবাজীর ছোটবেলার বন্ধুদের একজন|

খ্যাতি ও প্রশংসা

প্রথম ধারাবাহিক প্রকাশের সময় থেকেই সদাশিব প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে| পরে যখন সদাশিব বই হিসাবে প্রকাশ লাভ করে তখন তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে চলে আসে| খ্যাতির দিক দিয়ে শরদিন্দু রচিত ব্যোমকেশ বক্সীর পরেই সদাশিবের স্থান| সময়ের সাথেসাথে সদাশিব বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে একটি মাইল-স্টোন হয়ে ওঠে|

১৯৬০ সালে 'সদাশিবের তিন কান্ড' ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সান্মানিক পুরস্কারও লাভ করে|

সদাশিব ভিন্ন মাধ্যমে

আকাশবাণী কলকাতার তরফ থেকে সদাশিবের পাঁচটি পর্বই বেতার নাটক হিসাবে পুন:রচিত ও প্রকাশিত হয়|

১৯৭৯ সাল থেকে সদাশিব কমিকসের আকারে ততকালীন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সম্পাদিত বাংলা শিশু-কিশোর পত্রিকা আনন্দমেলায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়| বিশিষ্ট বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার এই কমিকসের চিত্রনাট্য রচনা করেন আর এর ছবি আকেন বিখ্যাত বাঙালি শিল্পী বিমল দাস| এই ধারাবাহিক কমিকসের জনপ্রিয়তা মূল রচনার মতই অবিলম্বে চরমে উঠে আসে|

প্রসংগত উল্লেখযোগ্য, বাংলা কমিকসের ইতিহাসে সদাশিবই প্রথম 'ছবিতে উপন্যাস' বা গ্রাফিক-নভেল|